ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি-কৌশল

২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের পর বিশ্বের খোলনলচে পাল্টে দেওয়ার মতো একের পর এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, যা বিশ্বব্যাপী আলোচিত হয়। নিম্নে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো।

ট্রাম্পের শুল্কনীতি
২০২৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাহী আদেশে কানাডা ও মেক্সিকোর পণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত ২৫% এবং চীনের পণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত ১০% শুল্ক আরোপ করেন। এ সংক্রান্ত নির্বাহী আদেশ শুধুমাত্র চীনের ওপর ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ থেকে কার্যকর হয়। নানা সমালোচনার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প কানাডা ও মেক্সিকোর ওপর প্রস্তাবিত ২৫% শুল্ক আরোপ এক মাসের জন্য স্থগিত করেন।

ট্রাম্পের শুল্কনীতিতে চীনের প্রতিক্রিয়াঃ
২০২৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি চীন ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যগুলোতে ১০-১৫% শুল্ক আরোপ করা হবে যা ২০২৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হয়।
সমঝোতাঃ কানাডা ও মেক্সিকো যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সমঝোতা করে নেয়। সমঝোতা অনুযায়ী কানাডা ও মেক্সিকো এক মাস সময়ের মধ্যে সীমান্তে নিরাপত্তা ও মাদক পাচার কমিয়ে আনবে। সমঝোতা অনুযায়ী কানাডা একজন 'ফেন্টানিল জার' নিয়োগ দেবে আর মেক্সিকো সীমান্তে ১০,০০০ সেন্য পাঠাবে।

Department of Government Efficiency (DOGE)
২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প Department of Government Efficiency (DOGE) নামে একটি দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন। DOGE এর উদ্দেশয় হলো ট্রাম্পের ফেডারেল ব্যয় হ্রাস এবং নিয়ন্ত্রণমুক্তকরণের এজেন্ডা বাস্তবায়ন এবং 'সরকারি দক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতা সর্বাধিক করার জন্য ফেডারেল প্রযুক্ত এবং সফটওয়্যার আধুনিকীকরণ করা। DOGE এর বর্তমান অস্থায়ী প্রধান ইলন মাস্ক। এটির সদর দপ্তর ওয়াশিংটনে অবস্থিত।

জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের ইতি
২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শপথ নেওয়ার পর অবৈধভাবে বাস করা ব্যক্তিদের সন্তানের জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের অধিকার রদ করেন। কিন্তু মার্কিন ফেডারেল আদালত ট্রাম্পের সেই প্রচেষ্টাকে অবৈধ বলে ঘোষণা করে এবং এ আদেশকে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে। প্রসঙ্গত, বিশ্বব্যাপী সাধারণত দুইভাবে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। ধরণ দুটি হলো 'জাস সোলাই' ও 'জাস সাঙ্গুইনিস'।

জাস সোলাইঃ জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বা জাস সোলাই (মাটির অধিকার) বিশ্বব্যাপী খুব বেশি প্রচলিত রীতি নয়। যুক্তরাষ্ট্রে দাসত্বের কবল থেকে মুক্তি পাওয়া মানুষদের আইনি স্বীকৃতি দিতে সংবিধানের ১৪তম সংশোধনী গৃহীত হয়। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্নের প্রায় ৩০ টি দেশের মধ্যে একটি, যারা নিজ দেশে জন্ম নেওয়া যে কাউকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নাগরিকত্ব দেয়।

জাস সাঙ্গুইনিসঃ জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের বিকল্প হলো অভিভাবকের জাতীয়তা বা নাগরিকত্বের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব নির্ধারণ করা। 'জাস সাঙ্গুইনিস' (রক্তের অধিকার) নীতির আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে জন্ম নেওয়া কোনো ব্যক্তির বাবা-মা যদি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হন, তাহলে ওই ব্যক্তি নাগরিকত্ব পেতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাওয়ার আর একটি উপায় হলো স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়া, যেখানে নির্দিষ্ট আইনি শর্ত পূরণ করতে হয়।
গত ১৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব দিচ্ছে। ১৮৬৮ সালে সংবিধানের ১৪তম সংশোধনী অনুমোদিত হওয়ার পর থেকে এটি কার্যকর রয়েছে। এই সংশোধনীতে বলা হয়, ' যেকোনো ব্যক্তি, যিনি যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেছেন বা এখানে নাগরিকত্ব অর্জন করেছেন এবং এখানকার আইনি অধীনস্থ, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের এবং যে রাজ্যে বসবাস করেন তার নাগরিক।

ধাতব মুদ্রা উৎপাদন বন্ধ
পেনি হলো যুক্তরাষ্ট্রের ধাতব মুদ্রার একক। যুক্তরাষ্ট্রের ধাতব মুদ্রা ১ ডলারের শতভাগের এক ভাগ হলো এক পেনি। একে এক সেন্টও বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ধাতব মুদ্রা পেনি উৎপাদন বন্ধের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০২৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে এ কথা জানান তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ব্যয় কমাতে এ উদ্যোগ নেন তিনি।

আর্থিক সহায়তা বন্ধ
বাংলাদেশ ও ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বড় ধরণের আর্থিক সহায়তা বাতিল করে যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইলন মাস্কের নেতৃত্বাধীন Department of Government Efficiency এই তথ্য জানায়।
বন্ধ হওয়া উল্লেখযোগ্য দেশের তহবিল
দেশ বিষয় অর্থ
মোজাম্বিক দক্ষতা সম্পন্ন যুবকদের একটি দল গড়ার জন্যে১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার
কম্বোডিয়া স্বাধীন কণ্ঠস্বর জোরদার করার জন্য ৯.৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার
ভারত ভোটারদের ভোটদানের জন্য ২১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার
বাংলাদেশ রাজনেতিক দৃশ্যপট শক্তিশালী করার জন্য ২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার
নেপাল আর্থিক ফেডারেলিজমের জন্য ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার
নেপাল জীববৈচিত্র্যের জন্য ১৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার

মানবাধিকার পরিষদ থেকে বিদায়
২০২৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্প জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ থেকে দেশকে বের করে নেওয়ার ঘোষণা দেন। ট্রাম্প এর আগে ২০১৮ সালের জুনে মানবাধিকার পরিষদ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। পরে জো বাইডেন মানবাধিকার পরিষদের প্রতি সমর্থন ফিরিয়ে আনেন।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিয়মিত পরিচালনা বাজেটের ২২% দিয়ে থাকে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে চীন।

Riviera of the Middle East
২০২৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছান নেতানিয়াহু এবং ৪ ফেব্রুয়ারি তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ ঘোষণায় গাজাকে খালি করে আবাসন এলাকা বা Riviera of the Middle East নির্মাণের ঘোষণা দেন। ট্রাম্প গাজা সম্পর্কে বিতর্কিত দাবি করেন মূলত এই ভিত্তিতে যে যুক্তরাষ্ট্রকে এই অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ নিতে হবে,  এর জনগণকে সরিয়ে ফেলতে হবে এবং পুনর্গঠন করতে হবে।

ICC'র উপর নিষেধাজ্ঞা
 ২০২৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্প আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (ICC) বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি সংক্রান্ত একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন। এর আগের মেয়াদেও ট্রাম্প নেদারল্যান্ডের হেগ এ ICC'র কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।

প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে প্রত্যাহার
২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম দিনেই প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহারের নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্পের এই প্রত্যাহারের মাধ্যমে গত এক দশকের মধ্যে এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ কার্বন নির্গমনকারী দেশটিকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক প্রচেষ্টার বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো। চুক্তির ২৮ ধারার অনুচ্ছেদ ২ অনুসারে ২০২৬ সালের ২৭ জানুয়ারি থেকে এ বিষয়টি কার্যকর হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ত্যাগ
২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি World Health Organization (WHO) থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করতে একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর আগে ২০২০ সালের জুলাইতে ট্রাম্পের প্রথম প্রশাসন আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার জরে নেয়।

পুনরায় গুয়ান্তানানো বে কারাগার প্রস্তুত
২০২৫ সালের ২৯ জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষরের মাধ্যমে ৩০,০০০ শরণার্থীকে গুয়ান্তানামো বে কারাগারে পাঠানোর জন্য সেখানে শরনার্থী শিবির তৈরির নির্দেশ দেন। ইতোমধ্যে সম্ভাব্য সেই কয়েদিদের জন্য বড় পরিসরে কারাগারের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির নির্দেশও দেওয়া হয় বলে জানান তিনি।
কিউবার গুয়েন্তানামো বে উপসাগরে মার্কিন নোবাহিনীর ঘাঁটি রয়েছে। সেই উপসাগরের উপকূলে একটি দ্বীপে অবস্থিত গুয়ান্তানামো বে কারাগার। ৯/১১ এর পরবর্তী সময়ে জঙ্গিদের আটক রাখতে ২০০২ সালের জানুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ এই কারাগার চালু করেন।

USAID কে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়ন্ত্রণে আনার পরিকল্পনা
২০২৫ সালের ৩১ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সংস্থা USAID' র স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে একে পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়ন্ত্রণে আনার পরিকল্পনার কথা জানায় ট্রাম্প। বিশ্বের বৃহত্তম একক দাতা সংস্থা USAID দীর্ঘদিন ধরে উন্নয়নমূলক কাজ করে আসছে। এমনকি যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই সেসব দেশেও মানবিক সহায়তা দেয় সংস্থাটি। তবে ট্রাম্পের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলে প্রতিষ্ঠিত USAID প্রশাসকের পদটিও বিলুপ্ত হয়ে য়াবে।

Comments